বৃহস্পতিবার, ০২ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২৬ পূর্বাহ্ন
মোশারফ হোসেন:
পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা এবং বংশের ধারকবাহক হিসেবে মায়েদের পথ অমসৃণ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎকর্ষের যুগেও যুগ যুগ ধরে চলে আসা গতানুগতিক প্রচলিত সেকালে ধ্যান-ধারণা প্রথা মূল্যবোধের প্রতি অন্ধবিশ্বাস অজ্ঞতা, অশিক্ষা, অদূরদর্শিতা, কূপম-ূকতা, অপসংস্কৃতি, কুসংস্কার বহুমাত্রিক প্রতিবন্ধকতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। দুঃখজনক হলেও সত্যি, এখনো প্রায় ৫৮ শতাংশ প্রসব হয়ে থাকে অপ্রশিক্ষিত সেবাদানকারীর মাধ্যমে। এটি সমাজের উন্নতি প্রগতি শান্তি সংহতি তথা সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই প্রতিবন্ধক। মা হওয়ার সময় মৃত্যুবরণের হার শহরের চেয়ে গ্রামে বেশি। যদিও বাংলাদেশ মাতৃমৃত্যুরোধকরণের জন্য জাতিসংঘ থেকে পুরস্কৃত হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে অসচেতনা, গর্ভকালীন প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবায় ঔদাসীন্য, অপ্রশিক্ষিত বা অশিক্ষিত, অদক্ষ দাইয়ের দ্বারা বাচ্চা প্রসব হওয়ার ফলে মাতৃমৃত্যুর হার বেশি।
বহুমাত্রিক প্রতিকূলতা সত্ত্বেও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রয়েছে। নানা সূচকে বাংলাদেশ বিশে^ রোল মডেল। ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জিত হলেও কিছু সামাজিক পশ্চাদগামিতাকে এখনো পুরোপুরি জয় করতে সক্ষম হয়ে ওঠেনি।
মা ও শিশুর নিরাপত্তাহীনতা যথার্থ প্রতিকার প্রতিরোধহীনতা অবহেলা-উদাসীনতার মানেই হচ্ছে প্রজন্মে আগামী প্রজন্মের সুরক্ষাহীনতা। শিশু জন্মদান ও মাতৃত্ব সম্পর্কিত সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা ও এগুলোর সুষ্ঠু সমাধানের খোঁজার প্রত্যাশা পূরণের সুদূরপ্রসারী চিন্তা-চেতনার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১৯৮৭ সালে শুরু হয়েছে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস।
মাতৃস্বাস্থ্য ও নবজাতকের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনা মিলিনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোলের (এমডিজি) অন্যতম সূচক।
সিডিও সনদের ১২নং ধারায় বলা হয়েছে, বাল্যবিবাহ মাতৃমৃত্যুর অন্যতম কারণ। বাল্যবিবাহ হচ্ছে, অকাল মৃত্যু। শরীর ও মনের স্বাভাবিক পারিপাশির্^ক অবস্থা বজায় না থাকার কারণেই অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরী সে একজন নিজেই শিশু, সেই শিশুটি আবার জন্ম দিচ্ছে আরেকজন শিশু। এতে করে মা শিশু এবং মা শিশুর কোলে জন্ম নেওয়া শিশু উভয়েই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (২০২০ সালের) গবেষণার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের ৫৩ শতাংশ মেয়ের অপরিকল্পিত গর্ভধারণ হচ্ছে।
পারিবারিক অসচেতনতা, ভুল চিকিৎসা, দরিদ্র্যতা, নারীর প্রতি পরিবারের অবহেলা-উদাসীনতা লিঙ্গভিত্তিক অসমতা, স্তরবিন্যাস, বৈষম্য, মানবিক মূল্যবোধহীনতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য এসবে কিছুই ঘুণে ধরা সমাজের সমাজ কাঠামোর অভ্যন্তরে নিহিত। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের ২০২২ সালের তথ্যানুযায়ী, গর্ভাবস্থায় এবং প্রসব সম্পর্কিত প্রতিরোধযোগ্য কারণে প্রতিদিন প্রায় ৮০০ নারীর মৃত্যু হয়। সেই হিসাবে প্রতি ২ মিনিটে ৮০০ জন নারী মারা যায়।
টেক্সাস এ অ্যান্ড এম ইউনিভার্সিটির গবেষণার তথ্যানুসারে, গর্ভাবস্থায় দূষণের সংস্পর্শে আসার ফলে শিশুর ওজন কম হতে পারে। অথবা নির্ধারিত সময়ের পূর্বেই শিশুর জন্ম হতে পারে এবং শিশুটি যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হবে তখন তার হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকতে পারে। একটি জাতিকে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, সর্বাগ্রে প্রয়োজন নীরোগ স্বাস্থ্যবান সুস্থ ও সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠার নিশ্চয়তা বিধান। আর তার প্রধান শর্ত হচ্ছে, পরিবেশের সুরক্ষা। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে তথা আগামীর সুন্দর জাতি নির্মাণকল্পে এখনই মনোযোগী হতে হবে।
২০৩০ সালের মধ্যে মাতৃমৃত্যু রোধকল্পে নানামাত্রিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবি। চিকিৎসকের মতে, কর্মজীবী মেয়েদের কমপক্ষে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রয়োজন। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সম্ভাব্য সমস্যাকে চিহ্নিত করেছেন। সেগুলো হলো :
১. পরিবার পরিকল্পনা ২. গর্ভকালীন সেবা
৩. নিরাপদ প্রসব ৪. জরুরি প্রসূতি সেবা
মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধ করতে এই চারটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃত্বকালীন প্রসূতি মায়ের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পারিবারিকভাবে একটি স্বস্তিদায়ক আবহ তৈরি করতে হবে। যাতে গর্ভবতী মা শারীরিক ও মানসিকভাবে নিখাদ সুখে সমৃদ্ধি তথা আনন্দময় সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতে পারবে। কারণ মায়ের শারীরিক মানসিক প্রশান্তি অনাগত শিশুর ওপর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিপরীতে অনাগত শিশুর ওপর নেতিবাচক প্রভাবের বিরূপতায় দেশ ও জাতির অপূরণীয় ক্ষতির হাত থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব হবে না। স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি অতীব গুরুত্ব সহকারে নিতে হবে। গর্ভের শিশুকে পরিচর্যা করার উপায় হচ্ছে, গর্ভবর্তী মাকে পরিচর্যা করা। তবেই সুস্থ সমাজ গড়ে উঠবে।
এক্ষেত্রে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তথা দুর্গম এলাকায় বসবাসকারীদের বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিতে হবে। চিকিৎসকের মতে, কর্মজীবী মেয়েদের কমপক্ষে ছয় মাস মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রয়োজন, বিশেষ করে গর্ভাবস্থায়। গর্ভপূর্ববর্তী সময় থেকে গর্ভপরবর্তী সব পর্যায়ে নারীর স্বাধীনতার অংশ হিসেবে নারীর নিজস্ব মতামতকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নিতে হবে। এক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি সরাসরি যুক্ত। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এনে, মাতৃস্বাস্থ্যের বিষয়টি আন্তরিকভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ দেশের সর্বস্তরে, নারীর অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে চাইলে মাতৃস্বাস্থ্যসেবায় ঔদাসীন্যের কোনো সুযোগ নেই।
লেখক : প্রভাষক, সরকারি ইস্পাহানী কলেজ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা।
mamun86cu@gmail.com